শফি চাকলাদার : বর্ষা ঋতু। বাংলা বর্ষপঞ্জির দ্বিতীয় ঋতু। আষাঢ় এবং শ্রাবণ এই দুটো মাস এই ঋতুর অন্তর্গত। আষাঢ়-শ্রাবণ নিয়ে প্রবন্ধ তৈরি করেছি। বর্ষা শব্দ নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হলো। লিখলাম। আষাঢ়-শ্রাবণ এবং বর্ষা ঋতু নিয়ে একত্রিত করে নজরুলের বর্ষা ঋতু বা কালের একটা বিশাল অবদান লক্ষ্য করতে পারি। এ নিবন্ধে আমি বর্ষাকাল নিয়ে কবির চয়নগুলো লক্ষ্য করব। বর্ষাকালের এক সুমধুর প্রাকৃতিক রূপ বর্ণনা এর মাধ্যমে পাওয়া যাবে-। কখনো বৃষ্টি সারাদিন ঝরছে। আকাশ ভরা মেঘ। বিদ্যুৎ বিজলি। কখনো গুমোট কখনো মেঘলা বাতাস। কখনো হু হু করা ঠা-া বাতাস। মানুষকে করে তোলে ঘরমুখো। কর্দমাক্ত পথ। সবকিছুর পরও বর্ষা ঋতুকে পছন্দ বেশিরভাগ মানুষের। কবিদের কথার বুননে ভেসে ওঠে নানান প্রাকৃতিক দৃশ্য। নজরুল কিভাবে উপভোগ করেছেন বর্ষাঋতুকে তারই বর্ণনা খুঁজে দেখি। সঙ্গীত বাণীতে নজরুল বর্ষাকে কিভাবে গেঁথেছেন প্রথমে তাই তুলে ধরি-
* কেন মিলন রাতে/মলিন আঁখি-পাতে
. কেন ফাগুন-প্রাতে/সহসা বাদল ঝরে
কেন উচাটন মন (বেহাগ-খাম্বাজ-দাদরা)
* বরষায় ফুটল না বকুল/পউষে ফুটবে কি সে ফুল.
. এ দেশে করে শুধু ভুল/ নিরাশার কানন ভরিয়া
মুসাফির! জোওরে আঁখি জল (বারোখাঁ-কাহারবা)
* আজি বাদল ঝরে/মোর একেলা ঘরে
হায় কী মনে পড়ে। মন এমন করে।
[ভৈরবী আশাবরী-আদ্ধা কাওয়ালি]
এই বাদল ঝড়ে/ হায় পথিক কবি
ঐ পথের পরে/আর কতকাল রবি,
ফুল দলিবি কত/হায় অভিমান ভরে
* পাঠালে ঘূর্ণি-দূতী ঝড়-কপোতী বৈশাখে সখি,
বরষায় সেই ভরসায় মোর পানে চায় জল-ভরা নদী॥
[আমার চোখ ইশারায় (জৈনপুরী-আশারবী কাহারবা)]
* গ্রীষ্মে নাচে বামা কালবোশেখী ঝড়ে
সহসা বরষাতে কাঁদিয়া ভেঙে পড়ে
[নমঃ নমঃ নমো বাঙলাদেশ সম (স্বদেশী)
* সেই বসন্ত ও বরষা আসিবে ফিরে ফিরে
আসিবে না আর ফিরে অভিমানী মোর ঘরে॥
[রহি রহি কেন আজো (পঞ্চমরাগ মিশ্র কাওয়ালি)
* কেতকী কদম যুথিকা কুসুমে বর্ষায় গাঁথ মালিকা
[একি অপরূপ রূপে মা বেহাবামিত্র কাওয়ালি]
* চলে নাগরী দোলে ঘাগরী/কাঁখে বর্ষা-জলের নাগরী [যায় ঝিলমিল ঝিলমিল ঢেউ
[ভীমপলশ্রী কাটা)
* বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু গেল না [শাওন আসিল ফিরে]
* বরষার দিন তো শেষ হয়ে গেছে/বরষার দিন তো শেষ হয়ে গেছে সারা
তবুও কেন ঝরে বাদল
* এলে কি বর্ষারাণী নিরশ্রু মোর নয়ন-লোকে [এলে কি স্বপন-মায়া আবার আমায়
* আমি যার বরষার আনন্দ কেকা [আমি যার নূপুরের ছন্দ-]
* খেলে চঞ্চলা বরষা-বালিকা
* ঘোর বরষায় ফাগুন যেন আলোয় ঝলমশল [বধূর চোখে জল]
* হেরি সেই নৃত্য ধরার চিত্ত/ডুবুডুবু বরিষার প্রেম-প্লাবনে [চঞ্চল শ্যামল এলো গগনে
* বাজে মৃরূঙ্গ বরষাল ওই দিকে ফালগুনের দোলনা দোলাতে
[দিয়ে গেল দোল গোপনে
* বরষার নব-ধারা-ছন্দে/এলে বনমুকুলের গন্ধে
[মম বেদনার শেষ হল কি এতদিনে]
* যদি বারি ঝরে কেয়াবনে/এমনি বরষা-ঘন রাতে [আমি যদি কভূ দূরে চলে যাই]
* কত বসন্তে কত বরষায়/খুঁজেছি তোমায় তারায় তারায়
[তোমারেই আমি চাহিয়াছি প্রিয়]
* রুম রুমঝুম জল- নূপুর বাজায়ে কে/ মোরে বর্ষার প্রভাতে গেলে ডেকে
* বাদল সাঁঝের যুঁই ফুল হয়ে/আসিয়াছি ধরা তলে
আসিব না আমি মাধবী নিশিথে/বরষায় শুধু আসিব ঝুরিতে
[বধূ আমি ছিনু বুঝি বৃন্দাবনের]
* আজ বরষায় দুখের রাতে/বন্ধুরে মোর পেলাম প্রাণে
[বিজলী খেলে আকাশে কেন-]
* কদম্ব ফুল সম উঠিছে শিহরি/প্রেম মম শ্যাম বরষায়
[মোর বেদনার কারাগারে জাগো]
* বাদলা-রাতে চাঁদ উঠেছে/কৃষ্ণ মেঘের কোলেরে
* দুখ শোকে দুর্দিনে বরষায়/নীরব-বরণ তব রূপ ভায়
[শ্যামল তুমি শ্যাম, তাই এ ধারা]
* বরষায় অবিরল ঝর ঝর ঝরে জল [কীর্তন রাধার কাঁদিয়া বরষ যায় (কীর্তন)]
* রিমঝিম রিম ঝিম বরষা এলো
* মনে পড়ে বরষায়/তার সেই অসহায় [াদল ঝর ঝর আনিল ভাদর]
* আসিবনা আমি মাধবী নিথিথে/বরষায় শুধু আসিব ঝুরিতে
[বধূ আমি ছিনু বুঝি বৃন্দাবনে]
* মুকুল বয়সে যথা বরষার ফুলদল [যাও মেঘদূত, দিও প্রিয়ার হাতে]
* গগনে খেলায় সাপ বরষা-বেদিনী
* রুম ঝুম ঝুম বাদল-নূপুর বোলে
* ঝরিছে অঝোর বরষার বারি [মল্লার-কাওয়ালি]
* বর্ষা গেল, আশ্বিন এলো, উসা এল কই
* বরষার মল্লারে মেঘে তুমি আনো [জয় হরপ্রিয়া শিবরজনী]
* মেঘ মেদুর বরষায় কোথা তুমি
* বরষে বাদর শাওন মে বব/বিকেল বেরকী চম্পা আউর
* ঝরে ববষামে ত্রি-ভূবন কি আনন্দাশ্রুলোর
* বর্ষা শেষে চাঁদের মতন/কে এলে মোর চিরচেনা বেহাগ-মান্দ-কার্কা]
* তুমি বরষায় ঝরা চম্পা/তুমি যুথিকা অশ্রুমতী [সিন্ধু-মিশ্র-দাদরা]
* অঝোর ধারায় বর্ষা ঝরে যখন তিমির রাতে [মুলতান-কানাড়া মিশ্র-দাদরা]
* নিবিড় তমসায় ঘনঘোর বরসায়/তরুণ অশান্তকে বিরহী [চাঁদী কেদারা-ক্রিতালী]
* বরষা ঐ এল বরষা মেঘ-মল্লার-ত্রিতালি]
* যেন আগুনের জোছনা হসিতরাতে/নামিল বরষা/ভোরে স্পনে কে তুমি দিয়ে দেখা
* এল বরষা শ্যাম সরমা প্রিয় দরশা/মনোহর/আসিবে তুমি জানি প্রিয়
* হায় পুড়িয়া বৈশাখে এলি ভিজিতে/অশ্রুর এ বরষায়/দূর বনান্তের পথ ভুলি (গজল)
শ্যামা তন্বী আমি মেঘ-বরণা
মোর দৃষ্টিতে বৃষ্টির ঝরে ঝরনা॥
অম্বরে জলদ মৃদঙ্গ বাজাই,
কদম কেয়ায় বন-ডালা সাজাই,
হাসে শস্যে কুসুমে ধরা নিরাভরণা॥
পূবালী হাওয়ায় ওড়ো কালো কুম্বল,
বিজলী ও মেঘ-মুখে হাসি, চোখে জল।
রিমিঝিমি নেচে যাই চল চরণা॥
বর্ষা, বাদল, বরষা নিয়ে বৃষ্টির এই ঋতুকে নজরুল প্রকৃতিকে সুন্দর রূপে উপস্থাপন করেছেন। বর্ষা, বাদল, আষাঢ়, শ্রাবণ নিয়ে গ্রীষ্মের পরবর্তী ঋতুটিই বর্ষা ঋতু। আষাঢ় এবং শ্রাবণ নিয়ে লিখেছি। বর্ষা নিয়ে এই প্রবন্ধ তৈরি করেছি। এখানেও প্রায় ঊনপঞ্চাশটি গান পাওয়া গেছে। সমৃদ্ধ হয়েছে বর্ষা ঋতু সঙ্গীত। সঙ্গীতে এসেছে বৈচিত্র। এ এক বিশাল সম্পদ বাংলা সঙ্গীত ভা-ারে। এই বর্ষা নিয়ে নজরুল ‘গল্পতেও দৃশ্য সাজিয়েছেন-
* বর্ষণ-পুলকিত পুষ্প-আকুলিত এই বল্লী-বিতানের আর্দ্র-¯িœগ্ধ ছায়ে বসে আমার মনে হয়, আমার প্রিয়তমাকে আমি হারিয়েছি; আবার মনে হয়। না, বড় বুক ভরেই পেয়েছি গো, তাঁকে পেয়েছি! আজি আমার ফুল-শয্যার নিশিভোরে হবে। এ ভোরে বারিও ঝরবে, বারি-বিধৌত ফুলও ঝরবে, আবার শিশুর মুখে অনাবিল হাসির মত শান্ত কিরণও ঝরবে। ওগো আমার বসন্ত-বর্ষার বাসর-নিছি, তুমি আর যেওনা-হায়, যেওনা/ ঘুমের ঘোরে।
এইসব কথা মনে পড়তেই আমি বৃষ্টি-ধারার ঝমঝমানির সাথে গলার সুর বেঁধে গাইলুম,- ওগো প্রিয়তম, এস আমরা দু’জনেই পিয়াসী চাতক-চাতকীর মত কালো মেঘের কাছে শান্ত বৃষ্টি-ধারা চাই। আমরা চাঁদের সুধা নেব না প্রিয়। আমরা তো চকোর-চকোরী নই। চাতক-মিথুন বাদলের দিনে আমরা চাইব শুধু বর্ষণের পূত আকুল ধারা। এস প্রেয়সী আমার, এই আমাদের ফালগুনের মেঘ-বাদলের দিনে আমরা উভয়কে স্মরণ করি আর চলে যাই। এই বসন্ত-বর্ষার নিশিথনীর মতোই আমার মনের মাঝে এসো তোমার গুঞ্জরণ-ভরা ব্যথিত চরণ ফেলে।
... তারপরে দূরে দাঁড়িয়ে সজল চারিটি চোখের চাউনির নীরব ভাষায় বলি, ‘বিদায়’!... ঐ
* আজ ভোর হতেই আমার পাশের ঘরে (কোয়ার্টারে) যেন গানের ফোয়ারা খুলে গেছে, মেঘমল্লার রাগিণীর যার যত গান জমা আছে, ‘স্টকে’ কেউ আজ গাইতে কসুর করছেন না। কেউ ওস্তাদি কায়দায় ধরছেন, ‘আজ বাদরি বরিখেরে ঝমঝম’! কেউ কালোয়াতি চালে নাচ্ছেন,- বধূ এমন বাদরে তুমি কোথা!’-এই উল্টো দেশে মাঘ মাসে বর্ষা, আর এটা যে নিশ্চয়ই মাঘ মাস, ভরা ভাদর নয়, তা জেনেও একজন আবার কবাটি খেলার ‘চুঁ’ ধরার সুরে গেয়ে যাচ্ছেন, ‘এ’ ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর।’ সকলের শেষে গম্ভীর মধুর কণ্ঠ হাবিলদার পান্ডেমশাই গান ধরলেন, ‘হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে, সজল কাজল আঁখি পড়িল মনে।’ গানটা সহসা আমার কোন সুপ্ত ঘায়ে যেন বেদনার মত বিষয়ে বাজল! হাবিলদার সাহেবের কোনো সজল- কাজল আঁখি প্রেয়সী আছে কিনা এবং আজকার এই ‘শ্যামল ঘন নীল গগন’ দেখেই তার সেইরূপ এক জোড়া আঁখি মনে পড়ে গেছে কিনা, তা আমি ঠিক তা বলতে পারি নে, তবে আমার কেবলই মনে হচ্ছিল যেন আমার হৃদয়ের লুকানো সুপ্ত কথাগুলো এই গানের ভাষা দিয়ে এই বাদল রাগিণীর সুরের বেদনায় গলে পড়ছিল। [বাঁধন হারা (ক) করাচি সেনানিবাস, ২১ জানুয়ারি (প্রভাত)।
* যেই ভাবা, আর যায় কোথা, অমনি সঙ্গে সঙ্গে প্রবৃষ্ট মেঘের মতন গুরু গম্ভীর হয়ে-
-বাঁকুড়া ২রা ফেব্রু. (নিশুভ রাত্রির) বাঁধন হারা (জ)
* শিশুর ক্ষুদ্র মুখ ঝলমল করে চিরদুখিনীর কোলে- যেন বর্ষারাতের ম্লান চাঁদ। [মৃত্যু-ক্ষুধা]
* একটু আগের বর্ষা-ধোওয়া ছলছলে আকাশ। যেন একটি বিরাট নীল-পদ্ম। [শিউলি-মালা ১]
* বৃষ্টির ঝম্-ঝমানি শুনতে শুনতে সহসা আমার মনে হলো, আমার বেদনা এই বর্ষার সুরে বাঁধা। [বাদল-বরিষণে [এক নিমেষের চেনা]
* বর্ষার মেঘ চলে গেল। মর্মে আমার তারই গাঢ় গমক গুমরে ফিরতে লাগল, -ঐ- [অভিমানের দেখা-শো]
নজরুলের গল্প-উপন্যাস থেকে কিছু বর্ষা-মেঘ-বাদল-বৃষ্টির দৃশ্য তুলে ধরলাম। বর্ণনাগুলো উপভোগ্য। কাব্যিক এবং সুরেলা প্রকাশ বাদ্য রচনায় আলাদা ভাব-ব্যঞ্জন তৈরি করেছে। এবার ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি যেন নিজের জন্য তৈরি করেছেন-
আপনাদের আনন্দের জুবিলি উৎসব আজ যেন পরম বিরহীর ছায়াপাত বর্ষাসজল রাতের মত অন্ধকার হয়ে এলো, আমার সেই বিরহ সুন্দর প্রিয়তমকে ক্ষমা করবেন-
ময়মনসিংহ জেলা কৃষক-শ্রমিক সম্মেলন ১৯২৬ এর ১৭ ও ১৮ জানুয়ারি ময়সনসিংহ শহরে অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে প্রদত্ত প্রবন্ধতে পাই বর্ষা-বন্দনা
-আমার এই কৃষাণ ভাইদের ডাকে বর্ষায় আকাশ ভরিয়া বাদল নামে, তাদের বুকের ¯েœহধারার মতই মাঠ-ঘাট পানিতে বন্যায় সয়লাব হইয়া যায়, আমার এই কৃষাণ ভাইদের আদর সোহাগে মাঠ-ঘাট ফুলে ফসলে শ্যাম-সবুজ হইয়া ওঠে, আমার কৃষাণ ভাইদের বধূদের প্রার্থনায় কাঁচা ধান সোনার রঙে রাঙিয়ে ওঠে- এই মাঠকে জিজ্ঞাসা করো, মাঠে ইহার প্রতিধ্বনি শুনিতে পাইবে, এ মাঠ চাষার এ মাটি চাষার, এর ফুল-ফল কৃষক-বধূর।
* আচ্ছা ধরুন, যদি বায়বীয় ইলেকট্রিসিটির উপরে বর্তমান অপেক্ষা শত বা সহ¯্র গুণ ভার চাপানো হয় তাহা হইলে আর কি বসন্তে ফুল ফুটিবে, কচি পাতা গজাইবে? আর কি তবে বর্ষার ব্যাকুল বরিষণ পৃথিবীর বক্ষ সিক্ত করিবে? না গো না! তার বদলে বজ্র পতনই হইবে আমাদের পৃথিবীতে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। [রোজ কেয়ামত বা প্রলয়ের দিন]
বৃষ্টি-বর্ষা-প্রাবৃট-বাদল নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ-গল্প-উপন্যাস থেকে বর্ণনা পড়লাম। বৃষ্টি-বর্ষার সময় প্রাকৃতিক দৃশ্যের নানান বৈচিত্রীয় রূপ নজরুল ফুটিয়ে তুলেছেন, যা সাহিত্য-ভা-ারকে সমৃদ্ধ করেছে। কবিতায় বৃষ্টির নানান রূপ বর্ণনা এবার আলোচনায় রাখছি-
* এস মোর শ্যাম-সরসা
ঘনিমা’র হিঙুল-শোষা
বরষা প্রেম-হরষা
প্রিয় মোর নিকষ-নীলা।
[পুবের হাওয়া (ঝড়-পূর্ব-তরঙ্গ)]
* কাঁদে গ্রীষ্ম, কাঁদে বর্ষা, বসন্ত ও শীত
নিশিদিন শুনি বন্ধু, ঐ এক ক্রন্দনের গীত!
[সিন্ধু ১ম তরঙ্গ]
* ভরা ভাদরের বরিষণ এসে বারে বারে তোর কূলে
জানাবে রে তোরে সজল মিনতি, তুই চাহিবি না ভুলে? [যৌবন]
* বর্ষা বাদল মেঘের রাতে ঘনিয়ে যেদিন আসে
সেদিন আমার পাওনা দেখা নিবিড় নীলাকাশে। [ অদর্শনের কৈফিয়ত]
* আমার অশ্রু-বর্ষার শেষে ইন্দ্রধনুর মায়া
কেন এলে, যদি ছুঁইতে লুকাবে গগনে রঙিন কায়া? [দার্জিলিং-এ-৪]
* অপরূপ সে দুরন্ত
মন সদা তার উড়ন্ত
সে বৃষ্টিধারার সাথে পড়ে জলে,
অস্ত-রবির আড়াল টেনে লুকায় গগন-তলে।
সে চাঁদের আলো, বর্ষা-মেঘের জল,
আপনার খুশিতে করে আপনি সে চঞ্চল। [অপরূপ সে দুরন্ত]
* ‘তুই যে আমার, এই তো সেদিন আমার বুকে ছিলি।’
বর্ষার মেঘ ডাকে, খুলে বিজলি-ঝিলিমিলি। [কোথায় ছিলাম আমি]
* তৃষিত চাতক! এরি লাগি কিরে এত দিন বসেছিলি
চাহিয়া শুষ্ক গগনে- খুলিয়া নয়নের ঝিলিমিলি?
এরি লাগি জাগি কাটালি অধীর।
মধু-মাসে চাস বরষার নীর?
এই জল চাহি এতদিন ধরি এত আঁখি-জল দিলি?
কে জানে কাহার দুঃখে আকাশ কাঁদিতেছে নিরিবিলি। [প্রথম অশ্রু]
* সাতরঙা ঐ ইন্দ্রধনুর লাল রঙটাই দেখল যারা,
তাদের গাঁয়ে মেঘ নামায়ে ভুল করেছে বর্ষা-ধারা। [যুগের আলো]
* রবি শশী আলো দেয়, বৃষ্টি ঝরে-
সমান সব ঘরে, ইহাই নিয়ম আল্লার। [জয় হোক! জয় হোক!]
* কার করুণায় পৃথিবীতে এত ফসল ও ফুল হাসে
বর্ষার মেঘে নদ-নদী-¯্রােতে কার কৃপা নেমে আসে? [আল্লা পরম প্রিয়তম মোর]
* বর্ষা বলে, অশ্রু জলের মানিনী সে বিরহীনী
আকাশ বলে, তড়িত লজা, ধরিত্রী কয় চাতকিনী [অ-নামিকা]
* তব প্রেম-রাঙা ভাঙা জোছনা
হেরো শিশির-অশ্রু-লোচনা,
ঐ চলিয়াছে কাঁদি, বরষার নদী গৈরিক-রাঙা বসনা। [বিবাগিনী]
* জল-ভরা এই বর্ষাতে
হায় কারে সে ভরসাতে
পল্লি হতে আনবি বয়ে অশ্রু গোটা দুই,
আর চোখের জলে ভিজিয়ে দিবি রাজবাগানের ভুঁই। [বকুল]
* ওগো মোর লীলা-সাথী অতীত বর্ষার,
আজিকে শীতের রাতে নব অভিসার!
চলে গেছে আজি সেই বরষার মেঘ
আকাশের চোখে নাই অশ্রুর উদ্বেগ
যে-ফুল ফোটেনি ওরে তোর উপবনে
পূবালি হাওয়ার শ্বাসে বরষা-কাঁদনে [শীতের সিন্ধু]
* ফুল-ফসলের মেলা বসাবার বর্ষা নামার আগে,
কালো হয়ে কেন আসে মেঘ, কেন বর্জ্রের বাধা লাগে? [অভ্যুদয়]
* সে গান শোনায় মধুরতর গো সজল জলদ-চারী!
বর্ষায় ধোওয়া ফুলের সুষ্মা বর্ণিতে নাহি পারি। [আলো-আঁধারি]
* চারিদিকে তার রচিল প্রাচীর, তাও কিছুকাল পরে
বর্ষার ¯্রােতে ভেসে গেল। ওঠে আল্লার ঘর ভ’রে। [নওশাবা]
* হৃদয়ে যখন ঘনায় শাঙন, চোখে নামে বরষাত,
তখন সহসা হয় গো মাথায় এমনি বজ্রপাত! [চিরঞ্জীব জগলুল]
* বাদলা-কালো ¯িœগ্ধা আমার কান্তা এলো রিমঝিমিয়ে,
বৃষ্টিতে তার বাজল নূপুর পায়জোরেরই শিন্ধিনী যে।
ফুটল ঊষার মুখটি অরুণ, ছাইল বাদল তাম্বু ধরায়;
জমল আসর বর্ষা-বাসর, লাও সাকি লাও ভর-পিয়াসায়। [বাদল-প্রাতের শারাব]
* বন্ধু, বরষা, রাত্রি
কেঁদেছে যে সাথে সে ছিল কেবল বর্ষা রাতের সাথী [বাদল রাতের পাখি]
* ওগো বাদলের পরী!
যাবে কোন দূরে, ঘাটে বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী!
ওগো ও ক্ষণিকা, পুব-অভিসার কুরাল কি আজ তব?
পহিল্্ ভাদরে পড়িয়াছে মনে কোন দেশ অভিনব?
তোমার কপোল-পরশ না পেয়ে পান্ডুর কেয়া-রেণু,
তোমারে স্মরিয়া ভাদরের ভরা নদীতটে কাঁদে বেণু।
কুমারীর ভীরু বেদনা-বিষুর প্রণয়-অশ্রু সম
ঝরিছে শিশির-সিক্ত শেফালি নিশি ভোরে অনুপম।
ওগো ও কাজল-মেয়ে,
উদাস আকাশ ছল ছল চোখে তব মুখে আছে চেয়ে!
কাশফুল সম শুভ্র ধবল রাশ রাশ শ্বেত মেঘে
তোমার তরীর উড়িতেছে পাল উদাস বাতাস লেগে।
ওগো ও জলের দেশের কন্যা! তব ও বিদায়-পথে
কাননে কাননে কদম- কেকার ঝরিছে প্রভাত হতে।
তোমার আদরে মুকুলিতা হয়ে উঠিল যে বল্লবী
তরুর কণ্ঠ জড়াইয়া তারা কাঁদে দিবানিশি ভরি।
‘বৌ-কথা কও’ পাখি
উড়ে গেছে কোথা, বাতায়নে বৃথা বউ করে ডাকাডাকি।
চাঁপার গেলাস গিয়াছে ভাঙিয়া, পিয়াসী মধুপ এসে
কাঁদিয়া কখন গিয়াছে উড়িয়া ফসল-কুমুদী-দেশে।
তুমি চলে যাবে দূরে,
ভাদরের নদী দুকূল ছাপায়ে কাঁদে ছলছল সুরে।
যাবে যবে দূর হিমগিরি শিরে। ওগো বাদলের পরি,
ব্যথা করে বুক উঠিবে না কভূ সেথা কাহারেও স্মরি?
দেখা নাই জল, কঠিন তুষার, নির্মম শুভ্রতা,-
কে জানে কী ভাল বিধূর ব্যথা- না মধুর পবিত্রতা!
সেথা মহিমার ঊর্ধ্ব শিখরে নাই তরুলতা হাসি,
সেথা রজনীর রজনীগন্ধা প্রভাতে হয় না বাসি।
সেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা-নূপুর খুলি,
চলিতে চকিতে চমকি উঠোনা, কবরী উঠে না দুলি।
সেথা রবে তুমি ধেয়ান-মগ্না তাপসিনী অচপল,
তোমার আশায় কাঁদিবে ধরায় তেমনি ‘স্ফটিক-জল’। [বর্ষা বিদায়]
বর্ষা শুধু শুধু পানি বর্ষণ নয়। এ আল্লাহর রহমত। তাই ‘উঠিয়াছে ঝড়’ কবিতায় নজরুল ঐ বাণী স্মরণ করে রচেন ‘বার্ষায় ঝরে রহমত-পানি-প্রতীক্ষমাণ সাত স্বরগ’। কবিতাটির চতুর্থ লাইন নজরুল শুরু করেছেন ‘পহিল’ শব্দ দিয়ে। ‘প্রথম’ লিখতে পারতেন। কিন্তু ‘পহিল’ শব্দটি খাবারের সাথে চাটনি যুক্ত করলে খাওয়া যেমন ‘মুখরোচক’ হয়ে ওঠে। ‘পহিল’ শব্দ চয়ন এখানে তেমনি কাজ করেছে। নজরুল এমন ‘পহিল’ যুক্ত করেছেন আরো একাধিক স্থানে। দু’একটি উদ্ধৃতি দিলে পড়–য়াদের জানার কৌতুহল বেড়ে উঠবে-
-অধর-কোণে হাসির ফালি ঈদের পহিল চাঁদের মত [শাখ-ই-নবাত]
-পহিল প্রেমের উদয়-ঊষার রাঙা সওগাত [খদিজা]
‘বর্ষা’ বা বর্ষা ঋতু নিয়ে নজরুলের অসংখ্য কাজ তুলে ধরা হলো। যেখানে সঙ্গীত রয়েছে, বাণীর খেলায় নয়নে ধরণ বাক্য-মেজাজ অনুধারে নজরুল বর্ষা-বৃষ্টিকে প্রয়োগ করেছেন। সঙ্গীত প্রকৃতি হয়ে উঠেছে আকর্ষণীয়, বাণী হয়ে উঠেছে সমৃদ্ধ। গল্পে এই বর্ষা-বৃষ্টি-বিদ্যুৎ-বজ্র ব্যবহার প্রকৃতিকে সুন্দর এবং বাস্তব করে তুলে ধরেছেন। তেমনি উপন্যাস, পত্রে, কবিতায় এই বর্ষা-বৃষ্টির ‘রিমঝিম রিম ঝিমঝিম ঘন দেয়া বরষে’ বাক্য বৃষ্টির প্রকৃতিকে দেখবার জানবার কৌতুহলকে বৃদ্ধি করেছে। সমৃদ্ধ করেছে। বৃষ্টি যখন শুরু হয় তখন মনের কোণে গুঞ্জরিত হয়, ‘রিমি রিম ঝিম রিমঝিম নামিল দেয়া’ কিম্বা ‘রুমঝুম ঝুম বাদল নূপুর’ সূর বৃষ্টির জল ধারার সাথে ভেসে ওঠে। প্রকৃতির সৌন্দর্য শ্রুতির কাছে মধুর হয়ে ওঠে। বৃষ্টি ঋতু যে নজরুলের প্রিয় তা তার সমৃদ্ধ অবদানগুলো বলে দেয়। বলে দেয় বর্ষার সুর-সঙ্গীত-সহ গল্প বুনন ‘বাদল-বরিসনে’সহ অসংখ্য অবদানে বাংলা সুর-বাণী-কখন এ নজরুলই শ্রেষ্ঠতম স্থানে প্রতিষ্ঠিত। তাই শেষ করছি নজরুল তার বর্ষার অনবদ্য সৃষ্টিগুলোর মাঝে বলতে পারেন, গজল গান ‘দূর বনান্তের পথ ভুলি কোন বুলবুলি বুকে মোর আসিলি হায়’ এর শেষ অন্তরাতে-
নিকুঞ্জে কার গাইতে গেলি গান
বিঁধিলি বুক কণ্টকে
হায় পুড়িয়া বৈশাখে এলি ভিজিতে
অশ্রুর এ বরষায়॥
নজরুল যখন লেটো দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তখন অসংখ্য পালা’র গান রচেছিলেন। নানান ধরনের গান। সেখান থেকে একটি গান তুলে ধরছি। ডুয়েট গান। সেখানে বর্ষা ঋতুর কথা না থাকলেও উপমা রয়েছে বর্ষাকে মাথায় রেখে। প্রেমের কথোপকথন, এক অন্তরার গানের মুখরাতে-
ছেলে : বৌ কথা কও, বৌ কথা কও,
মেয়ে : আমি কইবো না আর কথা।
ছেলে : তুইলো আমার মাথার মণি
বর্ষাকালের ছাতা।
অপূর্ব প্রাকৃতিক বর্ণনায় বরষার উস্থাপন। দারুণ বর্ণনায় বরষার দৃশ্য পরিস্ফুটন এই ‘রাখিবন্ধন’ কবি দৃশ্য অঙ্কন করেন এভাবে- উপমার রাজা নজরুল এখানে তাই প্রমাণ করেছেন বরষা-মেঘ নিয়ে-
ঝরা-বৃষ্টির ঝর ঝর আর পাপিয়া শ্যামার কূজনে
বাজে নহবত আকাশ-ভুবনে-সই পাতিয়েছে দু’জনে।
আকাশের দাসী সমীরণ আনে শ্বেত পেঁজা মেঘ কেনা ফুল,
হেথা জলে-থলে কুমুদে কমলে আলুথালু ধরা বেয়াকুল।
আকাশ গাঙে কি বান ডেকেছে গো, গান গেয়ে চলে বরষা,
বিজুড়ির গুণ টেনে টেনে চলে মেঘ-কুমারীরা হরষা।
হেথা মেঘ-পানে কালো চোখ হানে মাটির কুমার মাঝিরা
জল ছুঁড়ে মারে মেঘ-বালা দল, বলে, ‘চাহে দেখো পাজিরা।’