মেদিনীপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পেডি হত্যা /সূর্যকান্ত মাহাতো (2023)

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ৭১

মেদিনীপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পেডি হত্যা

সূর্যকান্ত মাহাতো

"১৯৩১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী। নির্জন কাঁসাই নদীর তীরে এক গোপন স্থানে বিমল দাশগুপ্ত, শশাঙ্ক দাশগুপ্ত, ফণী কুণ্ডু এবং যতিজীবন ঘোষের সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পেডিকে হত্যা করা হবে। কিন্তু প্রথমবার যে ছক তারা তৈরি করেছিলেন তা ভেস্তে যায়। এই ব্যর্থতায় কেন্দ্রীয় কমিটি খুব একটা খুশি হয়নি। তাই একশান স্কোয়াডের সদস্য প্রফুল্ল দত্ত(বিমল দাশগুপ্তরা একে 'ফুলদা' বলে ডাকতেন) ব্যাপারটা দেখার জন্য মেদিনীপুরে আসেন ২৫ শে মার্চ। এবং ওই দিনই সন্ধ্যা সাতটার সময় ফণী কুন্ডু, যতিজীবন, প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য এবং বিমল দাশগুপ্তকে নিয়ে আরো একটি গোপন বৈঠক করেন। প্রফুল্ল দত্ত বলেন, 'আমরা টেনে টেনে ওই রক্তখেকো ইংরেজ শাসকদের হত্যা করব।'(রক্তের অক্ষরে/শৈলেশ দে, পৃষ্ঠা- ১৫১) ১লা এপ্রিল আবারও পেডি হত্যার ছক তৈরি হল। কিন্তু না এবারও হল না। কারণ মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে ছাত্র 'প্রদর্শনী' উদ্বোধন করতে আসার কথা থাকলেও পেডি সাহেব এলেন না। তার পরিবর্তে এসেছিলেন এ.ডি.এম.। অবশেষে তার ঠিক ছদিন পরেই এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ওই দিনই কলেজিয়েট স্কুলে প্রদর্শনীর শেষ দিন ছিল। খবর পাকা যে পেডি সাহেব কোথায় যেন শিকারে গেছেন, সেখান থেকেই এখানে আসবেন। পাঁচটার পর সন্ধ্যের মুখে পেডি সাহেব যখন নিবিষ্ট মনে প্রদর্শনী দেখছেন সেই সময় বিমল দাশগুপ্ত ও যতিজীবন ঘোষ অকস্মাৎ লাফ মেরে পেডির কাছে পৌঁছে গিয়ে গুলি চালিয়েছিলেন। গুলি করার পরে ঠিক কী হয়েছিল তার বর্ণনা বরং স্বয়ং বিমল দাশগুপ্তের নিজের বর্ণনাতেই শোনা যাক,

"আমাদের চোখে তখন আগুন। দুচোখ মেলে আমরা দেখলাম আমাদের সম্ভ্রমহারা লাঞ্ছিতা মা-বোনেদের অভিশাপ আগুনের হল্কা হয়ে যেন আহত পেডিকে দগ্ধে মারছে। পেডি কেঁপে কেঁপে গা মোড়াচ্ছিলেন। মুহূর্তে পড়ে গেলেন পাশের বেঞ্চের উপর। আমাদের বুলেট খতম হয়ে গেছে। আমরা তৈয়ের হচ্ছি সায়ানাইড ভরা এম্পুল চিবানোরর জন্য। একবার তাকালাম চতুর্দিকে। কি আশ্চর্য! ঘরের মধ্যে জনপ্রাণী নেই- সব ফাঁকা। বীরপুরুষরা যে যার প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে, আমাদের বাধা দেবার জন্য কেউ নেই। আমরা নিরাপদে বেরিয়ে এলাম। ঠিক করলাম সাইকেলে বাঁকুড়া চলে যাব।" (সেদিন পেডিকে হত্যা করেছিলাম/ বিমল দাসগুপ্ত,অগ্নিযুগ- শৈলেশ দে, পৃষ্ঠা -১৯৫) (উপরের ঐ বর্ণনার সম্পূর্ণ অংশটি 'রক্তের অক্ষরে' বইয়ে শৈলেশ দে 'বিমল দাশগুপ্তের দলিল' অংশে বর্ণনা করেছেন।)

তাই কাউকে সেখানে দেখতে না পেয়ে তারা নিরাপদে বেরিয়ে গিয়েছিলেন।

"পরদিন অর্থাৎ ৮ই এপ্রিল "মেদিনীপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে গুলি"এই শিরোনামে আনন্দবাজার পত্রিকায় সেই ঘটনার খবর প্রকাশিত হল। সেখানে লেখা হয়েছে, "মি:পেডি শিকার হইতে অদ্য সন্ধ্যাকালে শহরে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি সন্ধ্যা ৭ ঘটিকার সময় শিক্ষা প্রদর্শনী পরিদর্শনের জন্য স্থানীয় স্কুল ভবনে গমন করেন ওই সময় প্রদর্শনী ঘরের মধ্যে তাহার উপর গুলি বর্ষিত হয়।" (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৮ই এপ্রিল ১৯৩১, সূত্র- আমি সুভাষ বলছি/শৈলেশ দে)

"ঘটনার পরের পরের দিন, অর্থাৎ ৯ তারিখ আনন্দবাজার পত্রিকাই পেডির মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশ করল। "মেদিনীপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি: পেডির মৃত্যু" এই শিরোনামে। সেখানে লেখা হয়েছে, "জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার জেমস পেডি অদ্য অপরাহ্নকাল পাঁচটা দশ মিনিটের সময় মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন।" (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৯ই এপ্রিল, ১৯৩১)"

"বিমল দাশগুপ্তের আগে 'রামকৃষ্ণ রায়' নামের আর এক বিপ্লবী নাকি পেডিকে মেদিনীপুরগামী ট্রেনের মধ্যে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন?"

"হ্যাঁ। সেটা ওই বছরেই মার্চের মাঝামাঝি একসময়ের ঘটনা। 'রামকৃষ্ণ রায়' পেডিকে মারার জন্য এতটাই মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন যে বন্দুক ছিল না বলে ছোৱা দিয়েই হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রদ্যুৎ মেদিনীপুর কলেজের ল্যাবরেটারি থেকে পটাসিয়াম সায়ানাইড চুরি করে এনে সেই ছোরাতে লাগিয়ে দিয়েছিলেন।(বেঙ্গল ভোলেনটিয়ার্স/ মধুমন্তী সেনগুপ্ত, পৃষ্ঠা - ১২৪) কিন্তু সশস্ত্র পাহারা সহ পেডির কামরাটি বন্ধ থাকায় সেটা আর সম্ভব হয়ে উঠেনি। পেডিকে মারতে না পারার অক্ষমতায় সে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। তরুণদেব ভট্টাচার্য বর্ণনা করেছেন, 'আশাভঙ্গের বেদনায় কেঁদে ভাসালেন রামকৃষ্ণ।'(মেদিনীপুর, পৃষ্ঠা- ৩৯) মধুমন্তী সেনগুপ্ত বর্ণনা করেছেন, 'স্টেশন থেকে বেরিয়েই খোলা মাঠে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ল।'(বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স-অগ্নিযুগের সশস্ত্র বিপ্লবীদল, পৃষ্ঠা- ১২৫)"

"বিমল দাশগুপ্তর বর্ণনা শুনে তো মনে হল তাদেরকে কেউ চিহ্নিত করতে পারেনি। কারণ সে সময় ওই স্থান ফাঁকা হয়ে পড়েছিল। তারা নিরাপদেই সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। তাহলে তাকে পুলিশ চিহ্নিত করল কীভাবে?"

"সেটাও বেশ মজার বিষয়। আসলে কে এ কাজ করেছে সেটা ছিল তখনো ধোঁয়াশাময়। কয়েকজনকে সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার করেছিল ঠিকই, কিন্তু বিমল দাশগুপ্তের সন্ধান তারা তখনও পায়নি। সেই সন্ধান তারা পেল ঘটনার ১৬ দিন পর। তাও আবার খবরের কাগজের ভিত্তিতে। পেডি সাহেবকে কে হত্যা করেছেন তার খবর প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩১ সালের ২৩ শে এপ্রিল। আনন্দবাজার পত্রিকাতেই সেই খবর প্রকাশিত হয়।"

"কী লেখা হয়েছিল?"

"ঐদিন আনন্দবাজারে যে খবর প্রকাশিত হয় তার শিরোনাম ছিল, "বিমল দা সাহেবকে মারিয়াছে"। সেখানে লেখা হয়েছে, "কলেজিয়েট স্কুলের নিকটস্থ এক বাড়ির এক পরিচারিকার এক অল্পবয়স্ক পুত্র নাকি স্থানীয় লোকদিগকে বলিয়াছে যে, বিমলদা সাহেবকে মেরে পলাইয়া গিয়াছে।" (আনন্দবাজার পত্রিকা ২৩ শে এপ্রিল ১৯৩১, তথ্যসূত্র- আমি সুভাষ বলছি/ শৈলেশ দে।"

"পেডিকে হত্যা করাটা মেদিনীপুর জেলার 'বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স' শাখার একটা দারুন সাফল্যজনক ঘটনা বলা যেতে পারে। তবে মেদিনীপুরে বি. ভি. তথা 'বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স' গঠনের একটা ইতিহাস আছে। সেটা না জানলে পেডি হত্যার বিষয়টি খাপছাড়া হয়ে যাবে। 'বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স' এর সদস্যরা রাজনৈতিক হত্যার পরিকল্পনা কেন করেছিলেন বা পেডিকে কেন হত্যা করেছিলেন সেটা বোঝা যাবে না।"

বললাম, "কেন! আমিনুল ইসলামের রচিত গ্রন্থে তো সেই উত্তর আছে। আইন অমান্য আন্দোলনে পুলিশ যে বর্বরোচিত আচরণ শুরু করেছিল তার প্রতিবাদেই তো এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।" (ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অপ্রকাশিত ইতিহাস, পৃষ্ঠা- ৩৮২)"

"অবশ্যই। সে কথা তো তরুণদের ভট্টাচার্যও লিখেছেন, মেদিনীপুর জেলা ব্যাপী যে অত্যাচার ও উৎপীড়ন চলেছিল তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নায়ক ছিলেন পেডি। তাই বি. ভি.-র মেদিনীপুর শাখা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পেডিকে হত্যা করার। (মেদিনীপুর/ তরুণদেব ভট্টাচার্য, পৃষ্ঠা- ৩৯) আবার 'কমল কুমার কুন্ডু' তার গ্রন্থে বলেছেন, জেলাশাসক পেডী দাসপুরের চেচুয়াহাটে যে অমানবিক অত্যাচার করেছিলেন তাতে তার প্রতি মানুষের ঘৃণা ও অপমান বোধ তৈরি হয়েছিল বলেই এমন প্রতিশোধের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। (জিলা মেদিনীপুর: স্বাধীনতার আন্দোলন, পৃষ্ঠা-৫৫)"

"পেডি মানুষ হিসেবে খারাপ যেমন ছিলেন তেমনি ন্যায়পরায়ন বলেও তো তার সুনাম ছিল। তিনি যে মন্দ ছিলেন না সে কথাও তো বলা হয়েছে?"

"সেকি! এরকম কথাও বলা আছে নাকি?"

"'গোকুলেস্বর ভট্টাচার্য' তো সেরকমটাই বলেছেন। তার সপক্ষে যুক্তি হিসেবে বলেছেন, পেডি সাহেব নাকি ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে গভর্নমেন্ট থেকে দ্রুত অর্থ বরাদ্দ করে লোকের অসুবিধা দূর করতেন। (স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ১৬০) তবে তিনি এটাও বলেছেন যে সদগুন থাকলেও বন্দিদের উপর তার অমানুষিক নির্যাতনই বিপ্লবীদের চোখে শত্রুতে পরিণত হয়েছিলেন। আসলে ভালো খারাপ নিয়েই তো একটা মানুষ। কিন্তু পেডি সাহেবের খারাপটাই হয়তো বেশি করে চোখে পড়েছিল বিপ্লবীদের।

"এখনো পর্যন্ত মেদিনীপুরের জেলাশাসকদের হত্যা এবং বিপ্লবীদের কথা নিয়ে যতগুলো বই রচিত হয়েছে এসবগুলোই বর্ণনাধর্মী। এবং যথেষ্ট আবেগমাখা। তাই প্রকৃত ঘটনা আসলে কী ঘটেছিল তার সবথেকে ভালো উত্তর দিতে পারবে সেই সব বিপ্লবীরা, যারা পেডিকে হত্যা করেছিলেন। কারণ লেখকেরা কিছু তথ্যের উপর নির্ভর করে লেখেন আর এখানে যিনি ঘটিয়েছেন তার কোন তথ্য লাগে না। কারণ তার স্বীকারোক্তি বা বর্ণনাই তথ্য।"

মেদিনীপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পেডি হত্যা /সূর্যকান্ত মাহাতো (2)

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇

মেদিনীপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পেডি হত্যা /সূর্যকান্ত মাহাতো (3)

"কিন্তু এখন পেডি সাহেবের হত্যার প্রকৃত ঘটনা জানতে হলে তো হত্যাকারী বিমল দাশগুপ্তের নিজের মুখের বর্ণনা শুনতে হবে। তিনি তো আজ আর জীবিত নেই? তাহলে সেটা এখন কীভাবে সম্ভব? আমাদেরও তো তাই বিভিন্ন বইয়ের উপরেই নির্ভরশীল হতে হবে!"

"কে বলেছে, সেটা সম্ভব নয়? পেডি সাহেবকে হত্যায় শুধু নয়, ভিলিয়ার্স হত্যার প্রচেষ্টার কথা ও পেডি হত্যার 'বিচার পর্ব' সবকিছুই তিনি নিজে বর্ণনা করে গেছেন এক দলিলে। সেই দলিল প্রকাশিতও হয়েছে পরবর্তীকালে।"

"তাই নাকি! সেই দলিল প্রকাশিত হয়েছে? তাহলে তো অনেক কথায় জানা গেছে?"

"একদম। শুধু বিমল দাশগুপ্তের রচিত দলিলই নয়। মোট চারটি মূল্যবান দলিল প্রকাশিত হয়েছিল। এক) ফণীভুষণ কুন্ডুর দুই) বিমল দাশগুপ্তর তিন) নিরঞ্জীব রাযের এবং চার) ফনীন্দ্র কুমার দাসের। এই চারটি দলিলের থেকে বড় প্রমাণ মেদিনীপুরের ঐ ঘটনার আর কিছু নেই।"

"ঐ ঐতিহাসিক দলিলগুলো কে প্রকাশ করেছিলেন?"

"বিশিষ্ট লেখক শৈলেশ দে। তার "রক্তের অক্ষরে" গ্রন্থে এই চারজনের রচিত দলিলগুলো প্রকাশ করেছেন। এবং সেইসঙ্গে তিনি একথাও স্পষ্ট করে বলেন, ৪০ বছর ধরে অপ্রকাশিত এই দলিলগুলো পরবর্তীকালে যারা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস রচনা করবেন তাদের কাছেও অতি মূল্যবান হয়ে উঠবে। (রক্তের অক্ষরে, পৃষ্ঠা-১২৭)।"

"মেদিনীপুরে 'বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স' কীভাবে গড়ে উঠেছিল তার ইতিহাস কি ওই দলিলগুলোতে আছে?"

"অবশ্যই আছে। সেই কথাই তো তোমাকে বলছিলাম ।পেডি হত্যার আসল কারণ অনুসন্ধান করতে হলে এবং হত্যাকারী বিমল দাশগুপ্তকে সঠিকভাবে জানতে হলে এই দলিলগুলো বারবার করে পড়তেই হবে। সেখানে পেডি হত্যার কারণ হিসেবে কেবল পেডির অত্যাচারই নয় আরো অন্য বড় কারণ ছিল বলে মনে করা হয়।"

"কী কারন?"

"পেডি আসলে বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সদের বিপ্লবের সেই সময়কালের শিকার হয়েছিলেন বলা যেতে পারে।"

"সে কি! তার মানে পেডি অত্যাচারী ছিলেন বলেই যে তার মৃত্যুদণ্ড বিপ্লবীরা দিয়েছিলেন সেটাই নয়! বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সদের খতমের রাজনীতিরও শিকার তিনি!"

"হ্যাঁ। আসলে পেডির মৃত্যুর পিছনে এক বিপ্লবীর একটি ঘটনা(রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ ও সিম্পসন হত্যা) ও তার ফাঁসির ঘোষণাই বড় কারণ হয়ে উঠেছিল। সেই বিপ্লবী আর কেউ নন, তিনি হলেন মেদিনীপুর 'বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স' এর প্রতিষ্ঠাতা ও গুরু স্বয়ং দীনেশ গুপ্ত। যার হাতে মেদিনীপুরে বি.ভি.-র সংগঠন গড়ে উঠেছিল।"

"দীনেশ গুপ্তের সঙ্গে পেডি হত্যার যোগসূত্র কী?"

"'ফণীভূষণ কুন্ডু' তার দলিলে বর্ণনা করেছেন, কীভাবে মেদিনীপুরে বি.ভি. বিপ্লবীদের শাখা গড়ে উঠেছিল। সেখানে তিনি বলেছেন ১৯২৭ সালে মেদিনীপুর কলেজে ঢাকা থেকে একটি ছেলে এসে দ্বিতীয় বার্ষিক শ্রেণীতে ভর্তি হন। পড়াশোনার জন্য এলেও তার গোপন উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। সেই উদ্দেশ্য হল মেদিনীপুরে একটি বি.ভি.-র শাখা সংগঠন গড়ে তোলা। এই বি.ভি. বা 'বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের' পূর্ব নাম 'মুক্তিসংঘ' বলে মনে করা হয়। যার প্রধান ছিলেন হেমচন্দ্র ঘোষ। ১৯০৫ সালে তিনি ঢাকায় এই 'গুপ্ত সমিতি' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।"

কিন্তু মধুমন্তী সেনগুপ্ত উল্লেখ করেছেন দীনেশ ১৯২৮ সালে ঢাকা থেকে এসে মেদিনীপুর কলেজে ভর্তি হন। তিনি আবার এই তথ্যের সূত্র হিসাবে ক্ষিতিপ্রসন্ন সেনগুপ্ত দ্বারা প্রকাশিত 'শহীদ রক্তে সিক্ত মেদিনীপুর' গ্রন্থের ১৭ পৃষ্ঠার কথা উল্লেখ করেছেন। সেখানে বলা আছে আইএসসি পরীক্ষা দিতে না পারায় তিনি ১৯২৮ সালে মেদিনীপুর কলেজে আইএসসি-র সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি হন। শুধু তাই নয়, 'Calcutta Police Museum Archiver' এর ২০ পৃষ্ঠার কথাও উল্লেখ করেছেন। তাছাড়া বি.ভি. তো ১৯২৮ সালেই গড়ে উঠেছিল কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনের পর?"

"হতে পারে। তবে ফণীভূষণ কুন্ডু ও বিমল দাসগুপ্ত দুজনেই দীনেশের মেদিনীপুরে আসা ১৯২৭ সালের কথাই উল্লেখ করেছেন। যদি ১৯২৮-ই হবে তাহলে একই ভুল দুজনেই কীভাবে করলেন? বি.ভি.-র ক্ষেত্রভুমিটা তিনি ১৯২৭ থেকেই শুরু করেছিলেন।"

"'মুক্তিসংঘ' নামটা তো কখনো শুনিনি। মুক্তিসংঘই যে পরবর্তীকালে 'বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স' এতটা নিশ্চিত হলেন কীভাবে? মধুমন্তী সেনগুপ্ত উল্লেখ করেছেন 'বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স' প্রতিষ্ঠার পর 'মুক্তিসংঘ' তাতে যোগ দিয়েছিল। এমনকি বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স এর অধিকাংশ সদস্যই মুক্তিসংঘের।(বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স, পৃষ্ঠা - ৩১) তবে হেমচন্দ্র ঘোষ 'বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স' দলেরও সর্বাধিনায়ক ছিলেন বলেই কি এমন ধারণা?"

"'বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স' গঠনের পর 'মুক্তিসংঘ' আর ছিল না। সকলেই বি.ভি. -তে চলে এসেছিল তাই। হেম ঘোষের এই পার্টিটার কথা তখন যে বিপ্লবীরাও অনেকে জানতেন না সে কথা দলিলে বলেছেন ফণীভূষণ কুন্ডু। কারণ সেটা এতটাই বেশি গোপন রাখা হয়েছিল।"

"তার আগে মেদিনীপুরে কি এরকম কোন সংগঠন গড়ে উঠেনি?"

"ফণীভূষণ কুন্ডু বলেছেন, ১৯৮৭ তথা ওই বছরে প্রফুল্ল ত্রিপাঠী কয়েকজন তরুণ যুবকদের নিয়ে 'মেদিনীপুর যুব সংগঠন' নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন।(রক্তের অক্ষরে, পৃষ্ঠা- ১২৮) ফলে দীনেশের সঙ্গে পরবর্তীকালে প্রফুল্ল ত্রিপাঠীর যোগাযোগে অনেকেই দীনেশের সঙ্গে যুক্ত হতে পেরেছিল। দীনেশের লক্ষ্য ছিল কলেজের সেরা সেরা ছেলেগুলোকে তুলে আনা। দীনেশ গুপ্ত বলতেন, 'স্কুলের একটি ভালো ছেলেকেও হাতছাড়া করিও না। (রক্তের অক্ষরে, পৃষ্ঠা- ১৩০)"

"আর এভাবেই দীনেশের নেতৃত্বে অমর চট্টোপাধ্যায়, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, অনাথ পাঁজা, রামকৃষ্ণ রায়, প্রদোৎ ভট্টাচার্য, যতিজীবন ঘোষ, বিমল দাশগুপ্ত, প্রভাংশু পাল, নরেন দাস, ক্ষিতিপ্রসন্ন সেন যুক্ত হলেন এবং বি.ভি. গড়ে উঠল। সারা শহরে কয়েকটি ইউনিট বা গ্রুপে ভাগ হয়ে এই সংগঠন কাজ করত। দীনেশ শিক্ষা দিতে গিয়ে বলতেন, বিপ্লবীদের সর্বাগ্রে মানুষ হতে হবে। আদর্শের দিক থেকেই নয়, শারীরিক ও মানসিক দৃঢ়তা কীভাবে বাড়ানো যায় তার উপরও জোর দিতেন। সংগঠনের ছিল দুটো উইং। একটি হল সাংগঠনিক আর অন্যটি হল কভার্ট বা ওভার এক্টের জন্য তৈরি হওয়া। তাদের মুখপত্র ছিল 'বেনু' পত্রিকা। বিভিন্ন দেশের যেমন আয়ারল্যান্ড, ইতালি, ফরাসি, রাশিয়া, তুর্কি, চীন, জাপান, আমেরিকার মতো দেশগুলোর স্বাধীনতার ইতিহাস পড়ে পড়ে আদর্শ ও মনের শক্তি বাড়াতেন এই বিপ্লবীগণ।"

"বিমল দাশগুপ্ত কীভাবে পেডি হত্যার দায়িত্ব পেলেন?"

"বিমল দাশগুপ্ত তার দলিলে বর্ণনা করেছেন, দীনেশ গুপ্ত মেদিনীপুরে বি.ভি.-র শাখা গঠনের পর তাদের গুরু হয়ে উঠেছিলেন। তারা ছিলেন তার মন্ত্র শিষ্য। সেই গুরুই যখন ১৯৩০ সালে "রাইটার্স বিল্ডিংস অলিন্দ যুদ্ধ"র ঘটনা ঘটালেন তখন এই বিমল দাশগুপ্তের প্রতিক্রিয়াটা দেখলেই বুঝতে পারবে কেন পেডিকে টার্গেট হতে হয়েছিল।"

"কি প্রতিক্রিয়া ছিল?"

"বিমল দাশগুপ্তের নিজের কথায়, "আমাদের গর্বের সীমা নেই। আমাদের রক্তে আগুন জ্বলে উঠেছে। সর্বনাশের নেশায় আমরা মত্ত হয়ে উঠেছি। মনে হচ্ছে গুরু দীনেশ গুপ্তের আমরা যোগ্য শিষ্যত্বের পরিচয় অনায়াসে দিতে পারব।" (রক্তের অক্ষরে/ শৈলেশ দে, পৃষ্ঠা ১৪৮) আবার দেখো একটা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তারাও কেমন অধীর হয়ে উঠেছিল, তার কথায়, "আমরা অধীর। আমরা ক্রমাগত দাদাদের উপর চাপ দিতে লাগলাম মেদিনীপুরের সংগঠন যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করেছে। এবার আমাদের প্রচন্ড কোন অ্যাকশনের সুযোগ দেওয়া হোক। আমাদের প্রত্যেকের কণ্ঠে ছিল একটি কথা। Death before dishonour. Do and face death." (সেদিন পেডিকে হত্যা করেছিলাম/বিমল দাসগুপ্ত, অগ্নিযুগ- শৈলেশ দে, পৃষ্ঠা- ১৯০)"

"কীভাবে পেডি টার্গেট হলেন?"

"বিমল দাশগুপ্ত জানাচ্ছেন, ১৯৩১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি গোপন মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল মেদিনীপুর জেলার অত্যাচারের প্রতিমূর্তি ও মহিলাদের সম্ভ্রম হননকারী পেডি সাহেবকে চরমদন্ড দেওয়া হবে। (রক্তের অক্ষরে, পৃষ্ঠা- ১৪৯) এবং শেষে তাই করা হয়েছিল।"

চলবে...

Top Articles
Latest Posts
Article information

Author: Tyson Zemlak

Last Updated: 14/05/2023

Views: 5631

Rating: 4.2 / 5 (43 voted)

Reviews: 90% of readers found this page helpful

Author information

Name: Tyson Zemlak

Birthday: 1992-03-17

Address: Apt. 662 96191 Quigley Dam, Kubview, MA 42013

Phone: +441678032891

Job: Community-Services Orchestrator

Hobby: Coffee roasting, Calligraphy, Metalworking, Fashion, Vehicle restoration, Shopping, Photography

Introduction: My name is Tyson Zemlak, I am a excited, light, sparkling, super, open, fair, magnificent person who loves writing and wants to share my knowledge and understanding with you.